রমরমা ভাউচার বাণিজ্যে কতটা নিশ্চিন্ত গ্রাহক
অনলাইন কেনাকাটায় কিছু ই-কমার্স প্লাটফর্ম ভাউচারের বিপরীতে তিনগুণ পর্যন্ত পণ্য দিচ্ছে। এত বেশি অফার নিয়ে প্রতারণার আশংকার পাশাপাশি আরও কিছু প্রশ্ন উঠেছে।
এমন অফারে একজন গ্রাহক ১০০ টাকার ভাউচারে নির্দিষ্ট সময় পর ৩০০ টাকার পণ্য কেনার সুযোগ পাচ্ছেন।
এভাবে ভাউচার বাণিজ্যে এত বেশি ছাড় দেওয়ায় নানান প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এ রকম মাত্রাতিরিক্ত অফারে সম্ভাবনাময় ই-কমার্স খাত দীর্ঘমেয়াদে বড় ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। বাজারে অসম প্রতিযোগিতা তৈরির পাশাপাশি জালিয়াতির আশঙ্কাও থাকছে।
ইভ্যালি নামের একটি সাইট সম্প্রতি ১০ কোটি টাকার ভাউচার বিক্রি করে। পল্লীবাজার ডটকম নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানও বিপুল পরিমাণ এমন অফার দেয়। অনেক বেশি মুনাফার কারণে ক্রেতারা রমরমা এ অফারে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
টেকশহরডটকম এমন একজন ভাউচার ক্রেতার সঙ্গে কথা বলেছে যিনি আসলে ব্যবসায়ী। তিনি একা বেশ কয়েক লাখ টাকার ভাউচার কিনেছেন। নির্দিষ্ট সময়ে যে দোকান থেকে তাকে পণ্য দেওয়া হয়েছে তার আগেই তিনি ওই দোকানির সঙ্গে কথা বলে রেখেছিলেন। পরে তার কেনা পণ্য কমদামে সেই দোকানেই বিক্রি করে দিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, এক বন্ধুর কাছ থেকে ভাউচার কেনার কথা জেনে পরে সব বিষয়ে খোঁজ নিয়ে এই ব্যবস্থা করেছি। তাতে ভালো টাকা লাভ হয়েছে।
এমন মৌসুমী ক্রেতার সংখ্যা অনেক বলে জানিয়েছেন তিনি।
এ ট্রেন্ড তাহলে ই-কমার্সের জন্য কতটা সুখকর কিংবা এতে এ খাত কতটা এগোবে বা ক্ষতির মুখে পড়বে তা নিয়ে কথা বলছেন অনেকেই।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি ও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আজকেল ডিলের প্রধান নির্বাহী ফাহিম মাসরুর টেকশহর ডটকমকে বলেন, কয়েকদিন থেকে কিছু ই-কমার্স সাইটের নাম করে ডাবল, ট্রিপল লাভে ভাউচার বিক্রি করা হচ্ছে। বিপুল ভর্তুকি দিয়ে পণ্য বিক্রি করছে তারা। আইন অনুযায়ী সেটি অপরাধ। কারণ, দেশে এত ভর্তুকি দিয়ে পণ্য বিক্রির সুযোগ নেই।
বর্তমানে বেসিসের এ পরিচালক বলেন, ভাউচারে এমন ভর্তুকি দিলে বাজারে অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। তখন ক্রেতাদের মানসিকতাও বদলাবে। তারা মনে করবে, অনলাইন মানে বিশাল ছাড়ে পণ্য কেনার মহোৎসব; কিন্তু প্রকৃত অর্থ তো সেটা নয়।
প্রিয়শপ ডটকমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আশিকুল আলম খাঁন মনে করেন, এমন অফার ভাউচারের মতো জনপ্রিয় একটি পদ্ধতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
অনলাইন বা অফলাইন কেনাকাটায় ভাউচার অনেক আগে থেকেই ছিল জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, তবে এখন যেভাবে গ্রাহকদের প্রলুব্ধ করা হচ্ছে তেমনটি নয়। একজন চাইলেই ভাউচারে টাকার অংকের চেয়ে অনেক বেশি পণ্য বা সেবা অফার করতে পারেন না। এর একটা সীমা থাকা প্রয়োজন।
তার অভিযোগ এখন কিছু প্রতিষ্ঠান ই-কমার্সের নাম করে বাজারে ভাউচার ছাড়ছে। সেগুলো এক লাখ টাকার ভাউচারে দুই লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করছে। এভাবে কতদিন ভর্তুকি দেবে এসব প্রতিষ্ঠান প্রশ্ন করে তিনি বলেন, এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য কাজ করতে পারে।
এমন ভাউচার প্রথা শুরু করে ই-কমার্স সাইট ইভ্যালি। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবারে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য, নির্দিষ্ট সংখ্যক ভাউচার ছাড়ে। যেগুলোতে ৩০০, ২৫০, ২০০ ও ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত অফার দেওয়া হয়। গ্রাহকরা সেসব ভাউচার কিনে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্যও কিনতে পেরেছেন।
ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাসেল টেকশহরডটকমকে জানান, প্রথমবার তিন কোটি এবং দ্বিতীয়বার সাত কোটি টাকার ভাউচার বিক্রি করেন তারা। ইতোমধ্যে এসব ভাউচারের পণ্য গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে গেছে বলে দাবি তার।
ওই কর্মকর্তা বলেন, বিজ্ঞাপনে অর্থ খরচের বদলে সরাসরি গ্রাহককে ভর্তুকি দিতে ভাউচারের মাধ্যমে এমন অফার দেওয়ার কৌশল নেওয়া হয়। এটি ক্লিক করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, এতে গ্রাহকও লাভবান হয়েছেন। নতুন গ্রাহক তৈরি হয়েছে। এর সুফল শুধু তাদের প্রতিষ্ঠান নয়, পুরাে ই-কমার্স খাত পাচ্ছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, প্রতিদিন অনেক অর্ডার আসছে ইভ্যালিতে।
ভাউচার অফার বিদ্যমান ব্যবসার নিয়ম মেনেই দেওয়া হয়েছে, একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মও যথাযথভাবে মেনে করা হয়েছে বলে দাবি তার।
তবে এরপর আর কোনো ভাউচার ছাড়া হবে না বলে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
অন্যদিকে আরেকটি ই-কমার্স সাইট পল্লীবাজার ডটকম যাত্রা করেছে মাস ছয়েক আগে। প্রবাসী পল্লী গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠানটি এখন পরিচিতি পেতে ভাউচার ছেড়েছে বলে টেকশহর ডটকমকে জানিয়েছেন পল্লীবাজারের হেড অব বিজনেস রোকনুজ্জামান রিয়াজ।
ওই কর্মকর্তা জানান, বিজ্ঞাপনসহ প্রচারণা খাতের বাজেটের অর্থ গ্রাহকদের ভর্তুকি হিসেবে দেওয়া হচ্ছে ভাউচার অফারে।
তার দাবি, সরকারের প্রতিযোগিতা আইন মেনেই এটা করা হচ্ছে। এ অফারে টাকা নিয়ে গ্রাহকদের পণ্য না দেওয়ার অভিযোগ ওঠার সুযোগ নেই। কারণ তারা সবক্ষেত্রেই সরকারের মনিটরিংয়ের মধ্যে রয়েছেন।
প্রথমবার কত টাকার ভাউচার ছাড়া হয়েছে তা জানালেও সেই অংকের পরিমাণ ‘ভালো’ বলে উল্লেখ করেন তিনি। এর বড় অংশ বিক্রিও করেছেন তারা বলে জানান তিনি।
ভাউচারে বিমুখ হবেন সাধারণ ক্রেতা
সাধারণত ই-কমার্সে মানুষ কেনাকাটা করেন কিছুটা সুবিধার জন্য। বিশেষ করে দোকানে যাওয়ার ঝামেলা এড়াতে। ই-কমার্সগুলোও কিছুটা ছাড়ে পণ্য বিক্রি করতে পারে তাদের ‘ফিজিক্যাল’ শপ না থাকার সুবিধা নিয়ে। ফলে বিভিন্ন উৎসব-পার্বনে কিছুটা ছাড় দেয় সাইটগুলো।
বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তিরা মনে করছেন, চটকদার এ ভাউচার প্রথা ই-কমার্সের প্রকৃত গ্রাহকদের কেনাকাটায় বিমুখ করবে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, ক্রেতারা মনে করতে পারেন ই-কমার্স মানেই শুধু ছাড়ে পণ্য কেনা।
ফাহিম মাসরুর টেকশহর ডটকমকে বলেন, দেশে ই-কমার্সে কেনাকাটার অভ্যাস তৈরি করতে দীর্ঘদিন কাজ করতে হচ্ছে। এখন যদি শুধু ছাড়ের জন্যই ক্রেতারা কেনাকাটা করেন, তবে অন্য সময় ক্রেতা পাওয়া দুষ্কর হবে।
এসব বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন ইভ্যালির সিইও মোহাম্মাদ রাসেল। তিনি বলেন, ই-কমার্সে বিভিন্ন ধরনের ক্রেতা থাকেন। ভাউচার ছাড়ার পর কিছু ক্রেতা কম্পিউটার ও কম্পিউটার পণ্য কিনেছেন। কেউবা মোটরবাইক কিনেছেন। মানে নতুন ক্রেতা শ্রেণি তৈরি হয়েছে।
তবে হঠাৎ এ খাতে আসা মাত্র কোনো প্রতিষ্ঠান ভাউচার অফার দিলে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন এ উদ্যোক্তা। তিনি জানান, এমন অফার তারা আর দেবেন না বলে অফিসিয়াল ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। নতুন প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথভাবে অফারের বিপরীতে কতটা পণ্য সরবরাহ করতে পারবে তা নিয়ে গ্রাহকদের আগাম সতর্ক থাকতে হবে।
Komentar (0)
Post a Comment